Friday, June 3, 2022

রঞ্জিত বাবু

 কাল সারারাত ঠিকঠাক ঘুম হয় নি। গতকাল কোভিডের তৃতীয় ডোজ টিকা নিয়ে হাতের ব্যথাতে হাত নাড়াতে পারছিলাম না। সকাল বেলায় ফোনের নোটিফিকেশানএ এতগুলো মেসেজ দেখে মনটা অজান্তেই ঠাণ্ডা হয়ে এলো। ফেসবুক খুলে একটা ছবি দেখতে পেলাম। আশঙ্কাটা সত্যি হল। একের পর এক মেসেজ দেখে।

—— ০ ——
১৯৯২ সন। তখন এরকম ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন না যোগাযোগের এত সুবিধে বা মাধ্যম ছিল না। স্কুল ছুটির পর স্কুলের মাঠে খেলতে যেতাম ফুটবল বা ক্রিকেট । ভিডিও গেম বা মোবাইল ফোনর অ্যাপে কোন গেম খেলার কোথা স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি। সহজ সরল দিনগুলো এভাবেই হাসিখুশিতে চলে যেত। দু একজন একটু আধটু মন বিনিময় করছে, স্কুলের শেষে একটু আধটু এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি, চোখে চোখে চাওয়া চাওয়ি । অনেক কথা আদান প্রদান হত এভাবেই।
স্কুলের শেষে সাইকেল থামিয়ে দাঁড়ালেন তিনি। আমাকে ডাকলেন। ভয়ে আমি কুঁকড়ে গেলাম, কি জানি কি দেখে ফেলেছেন। কাছে যেতে সাহস হচ্ছিল না। বজ্রকঠিন ব্যক্তিত্ব । কখন চোখ তুলে তাকাতে সাহস হয়নি । দশম শ্রেণিতে উঠেছি সদ্য। দাপুটে ব্যক্তিত্ব যখন ক্লাসরুম এ পড়াতেন, সবথেকে দুষ্টু ছেলেটাও চুপ করে থাকত।
অথচ আমার মনে একটা খটকা ছিল চিরদিনই । কোনদিন জিজ্ঞাসা করতে পারিনি । কাউকে বলতেও পারিনি। সেটা হল ওঁর চুল আঁচড়ানোর অভ্যেস। মধ্যে সিঁথি করে চুল আঁচড়ানো তখন অলরেডি চালু হয়ে গেছে। বলিউডের অনেক নায়করাই তখন মধ্যে সিঁথি করে চুল আঁচড়ায়। যারা তখন কলেজে পরে, কিছুটা লায়েক হয়েছে, সবাই মধ্যে সিঁথি করে চুল আঁচড়ায়। কিন্তু একজন মাস্টারমশাই সেটা করবেন, ছাত্র হিসেবে মেনে নিতে কষ্ট হত। আমাদের আরও একজন স্যার এর ছিল এরকম স্টাইল। কিন্তু সে গল্প আর একদিন। কিন্তু মনে মনে একটা ভরসার কথাও ভাবতাম। সেটা হল এই যে, এরকম ব্যক্তিত্বের আড়ালে নিশ্চয় একটা খুব নরম মনের স্নেহময় ব্যক্তিত্ব লুকিয়ে আছে, না হলে আমাদের দেখা কঠোর মাস্টারমশাইদের ( যে রকম পথের পাঁচালির তুলসী চক্রবর্তী ) যে ছবিটা আমাদের মনে থাকে, তার সাথে তো ওঁর কোন মিল নেই।
ভয়ে ভয়ে এগিয়ে গেলাম। আমাকে বললেন, আগামী রবিবার থেকে দশটার পর যেন আমি ওঁর বাড়ি যাই। উনি আমাকে বাংলা পড়াবেন । সেই দিনহাটা রেল স্টেশনের সবথেকে দুরের যে সিগনাল, তার পাশের রাস্তা দিয়ে সাইকেল নিয়ে তাঁর বাড়ি পৌঁছলাম। তখন এরকম ইলেক্ট্রনিক সিগনাল ছিল না। রেল লাইনের সিগনাল এত কাছে থেকে কোনদিন দেখিনি । তারপর প্রত্যেক রবিবার গেছি ওঁর বাড়িতে। বাকিরা সবাই যখন রোববার সকালে টিভিতে চন্দ্রকান্তাতে মশগুল, আমি তখন ওঁকে চিনছি একটু একটু করে। প্রতিদিন। ওই বজ্রকঠিন মানুষটার আবরণ সরিয়ে আস্তে আস্তে তাঁর নরম হৃদয়টা বোঝার চেষ্টা করছি। ছোঁয়ার চেষ্টা করছি। মুখোমুখি আমি আর মাস্টারমশাই। বেশিরভাগ দিন খাবার ও জুটে যেত। আসলে প্রাইভেট টিউশন ছিলনা ওটা। কোনদিন টিউশন ফী নেননি আমার কাছে থেকে। আমি যেন ওই সময়টুকু ওদেরই বাড়ির একজন হয়ে যেতাম। মাধ্যমিক পরীক্ষার পর একটা শাল আর রাজশেখর বসুর চলন্তিকা রেখে এসেছিলাম ওঁর জন্য।
তারপর পড়াশোনা বা চাকরির সূত্রে বাইরে থাকলে, দেখা করতে যেতাম ওখানে গেলেই।
বিয়ের পর যতবারই বাড়ি গিয়েছি, দুজনে মিলে দেখা করতে গেছি অনেকবার। আমার স্ত্রীর কাছে তিনি মাস্টারমশাই নন, তিনি ছিলেন কাকু। একটা পারিবারিক আবহ ছিল সবসময়। তাই আজ সকালে তাঁর চলে যাওয়ার খবরটা আমার পরিবারেরই একজন চলে যাওয়ার সমান।
সব ঠিকঠাক থাকলে দু সপ্তাহ পরেই হয়ত দেখা হত। কিন্তু তাঁর তাড়া ছিল হয়ত কোথাও। অন্য কোথাও অন্য কারো জন্য হয়ত তাঁর স্নেহ ধরে রাখা ছিল।
সেরকমই হয়ত পনেরো বছরের কোন কিশোরকে খুঁজে নিয়ে বসবেন মুখোমুখি। আজ তাই কোন অভিযোগ নেই। রেস্ট ইন পিস বলব না। তাঁর অনেক কাজ। আরও অনেক অনেক হৃদয় ছোঁয়া এখন বাকি।

পল


বেলঘরিয়া এক নম্বর প্লাটফরম থেকে ওই যে ট্রেনটা এক্ষুনি বেরিয়ে গেল, ওটা থেকে নেমেই হনহন করে হাঁটা দিল ওই তরুণ। পিঠে বইয়ের একটা ভারি ব্যাকপ্যাক। টিউশন থেকে ফিরছে বাড়ি। বাড়ি বলতে মেস বাড়ি। কোচবিহারের কয়েকটা ছেলে মিলে একসাথে দু কামরার একটা ঘর ভাড়া নিয়েছে। একটা দোকানের ওপরে। কেউ মাস্টার্স করছে তো কেউ মেডিসিন। কেউ কম্পিটিটিভ পরীক্ষার প্রস্তুতি , কেউ বা ইঞ্জিনিয়ারিং। হেঁটে যেতে হবে দেশপ্রিয় নগর। রোজকার ব্যাপার। পকেটে পয়সা নেই অটোতে ওঠবার। বেলঘরিয়া হাইস্কুলের ওদিকে একটা ছেলেকে টিউশন পরিয়ে হাতখরচ জোগাড় হয়। তাই যেভাবে পারা যায় পয়সা বাঁচানোর চেষ্টা করে সে।
খারাপ লাগে না হাঁটতে। এদিক ওদিকের বাড়ি , দোকানপাট , সাইকেল স্ট্যান্ড, কচুরির দোকান। ওই যে ওল্ড নিমতা রোড , টেক্সমাকো যাওয়ার রাস্তা, যেখানে বেলঘরিয়ার আউটার সিগনাল, ঠিক ওই কোনেই একটা ক্যাসেটের দোকান, এসব দেখতে দেখতে, শুনতে শুনতে হাঁটবার রাস্তাটা বেশ আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। মাঝে মাঝে টিভির দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে পরে ইন্ডিয়া-সাউথ আফ্রিকার খেলা দেখা হয়।
ওইরকম এক পড়ন্ত বিকেলে হঠাৎ কানে এলো একটা নতুন গান। হাম রহে ইয়া না রহে কাল। ওই ক্যাসেটের দোকান থেকে। বাড়ি থেকে অনেকদূরে থাকে সে তরুণ। এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সে। সামনে অনেক কঠিন পথ। চাকরি পাবে কি না কোন নিশ্চয়তা নেই। এদিকে বাড়ি থেকে হাত পেতে পয়সা নিতেই কুণ্ঠা বোধ হয়। নিজের মত করে যাপন করছে জীবন আর আর একটু একটু করে প্রস্তুতি নিচ্ছে নগ্ন জীবনকে চিনে নেবার। প্রত্যেকটা পাইপয়সার হিসেব রাখতে হয়। এই গান যেন নিয়ে এলো একঝলক তাজা বাতাস। বুক ভরে শ্বাস নিলো সে। একেবারে আচ্ছন্ন করে নিলো ওই তরুণকে নিমেষেই। দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, দাদা ওই যে গানটা বাজছে ওই ক্যাসেটটা একটু দেখব ?
হাতে নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করেই আবার রেখে দিল সে। একটু অন্যরকম কভারটা। দু-টোনে করা কভার। নীল আর সাদা যেন। লেখাটাও যেন একটু অন্যরকম আর্টিস্টিক স্টাইলের। অনেকটা পশ্চিমি পপ ধাঁচের । না, বড্ড দাম। এই ক্যাসেট কেনার সামর্থ্য নেই ওই তরুণের।অনেকক্ষণ হাতে নিয়ে দেখেও রেখে দিতে হল। কিন্তু গানটা যে আচ্ছন্ন করে রেখেছে ওকে। কিছুতেই মাথা থেকে নামানো যাচ্ছে না , বরং একটা ভালবাসার অনুভূতি হচ্ছে।
ঠিক করল, সপ্তাহান্তে হাঁটতে হাঁটতে বন্ধুকে বলবে এই অদ্ভুত ভাল লাগার কথা। ঝিলের জলে পা ডুবিয়ে যখন বসে থাকবে দুজনে, কোন কথা থাকবে না কারো, সময়টাকে শুধু অনুভব করবে দুজনে পাশাপাশি বসে, তখন শুনবে দুজনে এই গান। মাধ্যমিকের পর একটা ওয়াকম্যান পেয়েছিল সে সোনির। এটা ওর সবচেয়ে বড় সম্পদ। শোনাবে বন্ধুকে ওই গান।
সময় নষ্ট না করে তড়িঘড়ি একটা ব্ল্যাংক ক্যাসেট কিনে আর গানের লিস্ট বানিয়ে দিয়ে এলো ওই দোকানে। ওই লিস্টের প্রথমেই থাকলো পল আর ইয়ারো, দোস্তি বড়ি হাসিন হ্যাঁয়। গায়কের নাম কে কে। ব্যাস ওইটুকুই। পুরো নাম জানা গেল না তক্ষুনি । তখন ইন্টারনেট বা মোবাইল ফোন বা সোশাল মিডিয়ার যুগ নয়। তাতে কি। গান তো ছুঁয়ে আছে হৃদয় জুড়ে। এক বুক গান নিয়ে অপেক্ষা করে আছে ওই তরুণ। রবিবারের। ঝিলের জলের।

বগটুই ২০২২

 

কয়েকটা ঘটি বাটি, ভাঙ্গাচোরা মাটির কলস
ভাতের ডেকচি, পরে আছে পাশে, পোড়া
ভাত হয়নি বুঝি এখনও, দু মুঠো অন্ন সংস্থান
কয়েকটা হাওয়াই চটি , স্ট্র্যাপ ছেঁড়া, নীল শাদা
এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে, জোড়া মেলানো ভার
লণ্ডভণ্ড চারিদিক, বাতাসে আগুনের উত্তাপ
পোড়া কাঠ , দরজার তালা এখনও অবিকল
কড়ি কাঠ থেকে ঝুলছে বিদগ্ধ ফ্যান, আনমনা
দুজন বন্ধু এসেছিল, ছেলেটাকে ডাকতে
খেলতে নিয়ে যাবে মাঠে, কোন সাড়া শব্দ নেই
খেলার মাঠ পড়ে আছে একা , শ্মশানের নিস্তব্ধতা
মাঝে মাঝে বাতাসে হাহাকার, কান্নার শব্দ মিশে আছে
খেলা আর হলনা শেষ বেলা, কেউ কোথাও নেই
পড়ে আছে বাক্সবন্দী রাংতায় মোড়া পুতুল, ঘুড়ি লাটাই
বইয়ের ব্যাগ, যেন কবেকার আগের মাটির চিহ্ন
উঠোনে দাগ কেটে এক্কা দোক্কা খেলা
ওই মানুষেরা এসেছিল, পুড়িয়েছে বিশ্বাস
ওখানেই বগটুই, ধ্বংসস্তূপ , আটজন লাশ