কাল সারারাত ঠিকঠাক ঘুম হয় নি। গতকাল কোভিডের তৃতীয় ডোজ টিকা নিয়ে হাতের ব্যথাতে হাত নাড়াতে পারছিলাম না। সকাল বেলায় ফোনের নোটিফিকেশানএ এতগুলো মেসেজ দেখে মনটা অজান্তেই ঠাণ্ডা হয়ে এলো। ফেসবুক খুলে একটা ছবি দেখতে পেলাম। আশঙ্কাটা সত্যি হল। একের পর এক মেসেজ দেখে।
—— ০ ——
১৯৯২ সন। তখন এরকম ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন না যোগাযোগের এত সুবিধে বা মাধ্যম ছিল না। স্কুল ছুটির পর স্কুলের মাঠে খেলতে যেতাম ফুটবল বা ক্রিকেট । ভিডিও গেম বা মোবাইল ফোনর অ্যাপে কোন গেম খেলার কোথা স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি। সহজ সরল দিনগুলো এভাবেই হাসিখুশিতে চলে যেত। দু একজন একটু আধটু মন বিনিময় করছে, স্কুলের শেষে একটু আধটু এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি, চোখে চোখে চাওয়া চাওয়ি । অনেক কথা আদান প্রদান হত এভাবেই।
স্কুলের শেষে সাইকেল থামিয়ে দাঁড়ালেন তিনি। আমাকে ডাকলেন। ভয়ে আমি কুঁকড়ে গেলাম, কি জানি কি দেখে ফেলেছেন। কাছে যেতে সাহস হচ্ছিল না। বজ্রকঠিন ব্যক্তিত্ব । কখন চোখ তুলে তাকাতে সাহস হয়নি । দশম শ্রেণিতে উঠেছি সদ্য। দাপুটে ব্যক্তিত্ব যখন ক্লাসরুম এ পড়াতেন, সবথেকে দুষ্টু ছেলেটাও চুপ করে থাকত।
অথচ আমার মনে একটা খটকা ছিল চিরদিনই । কোনদিন জিজ্ঞাসা করতে পারিনি । কাউকে বলতেও পারিনি। সেটা হল ওঁর চুল আঁচড়ানোর অভ্যেস। মধ্যে সিঁথি করে চুল আঁচড়ানো তখন অলরেডি চালু হয়ে গেছে। বলিউডের অনেক নায়করাই তখন মধ্যে সিঁথি করে চুল আঁচড়ায়। যারা তখন কলেজে পরে, কিছুটা লায়েক হয়েছে, সবাই মধ্যে সিঁথি করে চুল আঁচড়ায়। কিন্তু একজন মাস্টারমশাই সেটা করবেন, ছাত্র হিসেবে মেনে নিতে কষ্ট হত। আমাদের আরও একজন স্যার এর ছিল এরকম স্টাইল। কিন্তু সে গল্প আর একদিন। কিন্তু মনে মনে একটা ভরসার কথাও ভাবতাম। সেটা হল এই যে, এরকম ব্যক্তিত্বের আড়ালে নিশ্চয় একটা খুব নরম মনের স্নেহময় ব্যক্তিত্ব লুকিয়ে আছে, না হলে আমাদের দেখা কঠোর মাস্টারমশাইদের ( যে রকম পথের পাঁচালির তুলসী চক্রবর্তী ) যে ছবিটা আমাদের মনে থাকে, তার সাথে তো ওঁর কোন মিল নেই।
ভয়ে ভয়ে এগিয়ে গেলাম। আমাকে বললেন, আগামী রবিবার থেকে দশটার পর যেন আমি ওঁর বাড়ি যাই। উনি আমাকে বাংলা পড়াবেন । সেই দিনহাটা রেল স্টেশনের সবথেকে দুরের যে সিগনাল, তার পাশের রাস্তা দিয়ে সাইকেল নিয়ে তাঁর বাড়ি পৌঁছলাম। তখন এরকম ইলেক্ট্রনিক সিগনাল ছিল না। রেল লাইনের সিগনাল এত কাছে থেকে কোনদিন দেখিনি । তারপর প্রত্যেক রবিবার গেছি ওঁর বাড়িতে। বাকিরা সবাই যখন রোববার সকালে টিভিতে চন্দ্রকান্তাতে মশগুল, আমি তখন ওঁকে চিনছি একটু একটু করে। প্রতিদিন। ওই বজ্রকঠিন মানুষটার আবরণ সরিয়ে আস্তে আস্তে তাঁর নরম হৃদয়টা বোঝার চেষ্টা করছি। ছোঁয়ার চেষ্টা করছি। মুখোমুখি আমি আর মাস্টারমশাই। বেশিরভাগ দিন খাবার ও জুটে যেত। আসলে প্রাইভেট টিউশন ছিলনা ওটা। কোনদিন টিউশন ফী নেননি আমার কাছে থেকে। আমি যেন ওই সময়টুকু ওদেরই বাড়ির একজন হয়ে যেতাম। মাধ্যমিক পরীক্ষার পর একটা শাল আর রাজশেখর বসুর চলন্তিকা রেখে এসেছিলাম ওঁর জন্য।
তারপর পড়াশোনা বা চাকরির সূত্রে বাইরে থাকলে, দেখা করতে যেতাম ওখানে গেলেই।
বিয়ের পর যতবারই বাড়ি গিয়েছি, দুজনে মিলে দেখা করতে গেছি অনেকবার। আমার স্ত্রীর কাছে তিনি মাস্টারমশাই নন, তিনি ছিলেন কাকু। একটা পারিবারিক আবহ ছিল সবসময়। তাই আজ সকালে তাঁর চলে যাওয়ার খবরটা আমার পরিবারেরই একজন চলে যাওয়ার সমান।
সব ঠিকঠাক থাকলে দু সপ্তাহ পরেই হয়ত দেখা হত। কিন্তু তাঁর তাড়া ছিল হয়ত কোথাও। অন্য কোথাও অন্য কারো জন্য হয়ত তাঁর স্নেহ ধরে রাখা ছিল।
সেরকমই হয়ত পনেরো বছরের কোন কিশোরকে খুঁজে নিয়ে বসবেন মুখোমুখি। আজ তাই কোন অভিযোগ নেই। রেস্ট ইন পিস বলব না। তাঁর অনেক কাজ। আরও অনেক অনেক হৃদয় ছোঁয়া এখন বাকি।