Friday, June 3, 2022

পল


বেলঘরিয়া এক নম্বর প্লাটফরম থেকে ওই যে ট্রেনটা এক্ষুনি বেরিয়ে গেল, ওটা থেকে নেমেই হনহন করে হাঁটা দিল ওই তরুণ। পিঠে বইয়ের একটা ভারি ব্যাকপ্যাক। টিউশন থেকে ফিরছে বাড়ি। বাড়ি বলতে মেস বাড়ি। কোচবিহারের কয়েকটা ছেলে মিলে একসাথে দু কামরার একটা ঘর ভাড়া নিয়েছে। একটা দোকানের ওপরে। কেউ মাস্টার্স করছে তো কেউ মেডিসিন। কেউ কম্পিটিটিভ পরীক্ষার প্রস্তুতি , কেউ বা ইঞ্জিনিয়ারিং। হেঁটে যেতে হবে দেশপ্রিয় নগর। রোজকার ব্যাপার। পকেটে পয়সা নেই অটোতে ওঠবার। বেলঘরিয়া হাইস্কুলের ওদিকে একটা ছেলেকে টিউশন পরিয়ে হাতখরচ জোগাড় হয়। তাই যেভাবে পারা যায় পয়সা বাঁচানোর চেষ্টা করে সে।
খারাপ লাগে না হাঁটতে। এদিক ওদিকের বাড়ি , দোকানপাট , সাইকেল স্ট্যান্ড, কচুরির দোকান। ওই যে ওল্ড নিমতা রোড , টেক্সমাকো যাওয়ার রাস্তা, যেখানে বেলঘরিয়ার আউটার সিগনাল, ঠিক ওই কোনেই একটা ক্যাসেটের দোকান, এসব দেখতে দেখতে, শুনতে শুনতে হাঁটবার রাস্তাটা বেশ আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। মাঝে মাঝে টিভির দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে পরে ইন্ডিয়া-সাউথ আফ্রিকার খেলা দেখা হয়।
ওইরকম এক পড়ন্ত বিকেলে হঠাৎ কানে এলো একটা নতুন গান। হাম রহে ইয়া না রহে কাল। ওই ক্যাসেটের দোকান থেকে। বাড়ি থেকে অনেকদূরে থাকে সে তরুণ। এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সে। সামনে অনেক কঠিন পথ। চাকরি পাবে কি না কোন নিশ্চয়তা নেই। এদিকে বাড়ি থেকে হাত পেতে পয়সা নিতেই কুণ্ঠা বোধ হয়। নিজের মত করে যাপন করছে জীবন আর আর একটু একটু করে প্রস্তুতি নিচ্ছে নগ্ন জীবনকে চিনে নেবার। প্রত্যেকটা পাইপয়সার হিসেব রাখতে হয়। এই গান যেন নিয়ে এলো একঝলক তাজা বাতাস। বুক ভরে শ্বাস নিলো সে। একেবারে আচ্ছন্ন করে নিলো ওই তরুণকে নিমেষেই। দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, দাদা ওই যে গানটা বাজছে ওই ক্যাসেটটা একটু দেখব ?
হাতে নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করেই আবার রেখে দিল সে। একটু অন্যরকম কভারটা। দু-টোনে করা কভার। নীল আর সাদা যেন। লেখাটাও যেন একটু অন্যরকম আর্টিস্টিক স্টাইলের। অনেকটা পশ্চিমি পপ ধাঁচের । না, বড্ড দাম। এই ক্যাসেট কেনার সামর্থ্য নেই ওই তরুণের।অনেকক্ষণ হাতে নিয়ে দেখেও রেখে দিতে হল। কিন্তু গানটা যে আচ্ছন্ন করে রেখেছে ওকে। কিছুতেই মাথা থেকে নামানো যাচ্ছে না , বরং একটা ভালবাসার অনুভূতি হচ্ছে।
ঠিক করল, সপ্তাহান্তে হাঁটতে হাঁটতে বন্ধুকে বলবে এই অদ্ভুত ভাল লাগার কথা। ঝিলের জলে পা ডুবিয়ে যখন বসে থাকবে দুজনে, কোন কথা থাকবে না কারো, সময়টাকে শুধু অনুভব করবে দুজনে পাশাপাশি বসে, তখন শুনবে দুজনে এই গান। মাধ্যমিকের পর একটা ওয়াকম্যান পেয়েছিল সে সোনির। এটা ওর সবচেয়ে বড় সম্পদ। শোনাবে বন্ধুকে ওই গান।
সময় নষ্ট না করে তড়িঘড়ি একটা ব্ল্যাংক ক্যাসেট কিনে আর গানের লিস্ট বানিয়ে দিয়ে এলো ওই দোকানে। ওই লিস্টের প্রথমেই থাকলো পল আর ইয়ারো, দোস্তি বড়ি হাসিন হ্যাঁয়। গায়কের নাম কে কে। ব্যাস ওইটুকুই। পুরো নাম জানা গেল না তক্ষুনি । তখন ইন্টারনেট বা মোবাইল ফোন বা সোশাল মিডিয়ার যুগ নয়। তাতে কি। গান তো ছুঁয়ে আছে হৃদয় জুড়ে। এক বুক গান নিয়ে অপেক্ষা করে আছে ওই তরুণ। রবিবারের। ঝিলের জলের।

0 comments: